১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের মৌলিক দলিল, যার ভিত্তিতে কোনো রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে সে-সব বিষয়েঢ যাবতীয় নিয়মকানুন লিপিবদ্ধ থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রণীত ১২৯৭২ সালের সংবিধান সমগ্র জাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। পাকিস্থান যেখানে নয় বছর, ভারত তিন বছর সময় নেয়, সেখানে বাংলাদেশ মাত্র নয় মাসে (এপ্রিল ১৯৭২ – ডিসেম্বর ১৯৭২) জাতিকে সংবিধান উপহার দিতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি কয়টি ?
ব্যাখ্যা: বাংলাদেশ সংবিধানের মূলনীতি ৪ টি। যথাঃ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা।
১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ

১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকরকৃত বাংলাদেশ সংবিধানের কতকগুলো চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য একে অনন্য স্বকীয়তার সমাসীন করেছে। নিচে ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলেচনা করা হলো-
- লিখিত দলিল
- দুষ্পরিবর্তনীয়
- সর্বোচ্চ আইন
- প্রজাতন্ত্র
- প্রস্তবনা
- রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি
- মৌলিক অধিকার
- সংসদীয় পদ্ধতির সরকার
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
- প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল
লিখিত দলিল
বাংলাদেশের সংবিধান একটি লিখিত দলিল। ১৯৭২ সালের গৃহীত সংবিধানে ১ টি প্রস্তবনা, ১১ টি ভাগ, ১৫৩ টি অনুচ্ছেদ এবং ৪ টি তফশিল সন্নিবেশিত ছিল। তবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৩ টি নতুন তফশিল সন্নিবেশ করা হয়, যার ফলে বর্তমানে বাংলাদেশ সংবিধানের তফশিল সংখ্যা ৭ টি।
দুষ্পরিবর্তনীয়
১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয়। কারণ, এর কোনো নিয়ম পরিবর্তন বা সংশোধন বা সংযোজন করতে জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতির প্রয়োজন হয়। সংবিধানের দশম ভাগে সংশোধন পদ্ধতি সম্পর্কে উল্লিখিত আছে।
সর্বোচ্চ আইন
বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে দেশের প্রচলিত কোনো আইনের সংঘাত সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রে সংবিধান প্রাধান্য পাবে। অর্থাত যদি কোনো আইন সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যহীন হয়, তাহলে ঐ আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হয়ে যাবে।
প্রজাতন্ত্র
বাংলাদেশ সংবিধানের প্রথম ভাগ ছিল নতুন প্রজাতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট এবং আনুষ্ঠানিক বহি:প্রকাশ। এটি বাংলাদেশকে একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। এতে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানা, রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, জাতীয় প্রতীক, জাতীয় ফুল এবং জাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
প্রস্তবনা
জনগণের অভিন্ন অভিব্যক্তি ও রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শস্বরূপ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সর্বোচ্চ আদর্শকে সুনিশ্চিত করে, যা আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তির জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও প্রাণ উতসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এসব আদর্শই সংবিধানের মূলনীতি বলে উল্লেখ করা হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি
সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আকারে রাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূলনীতিসমূহের ঘোষণা সন্নিবেশিত হয়েছে। এতে সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত চারটি মূলনীতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। মূলনীতি চারটি হলো- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
মৌলিক অধিকার
১৯৭২ সালের সংবিধানের গৌরবময় দিক হলো ২৬-৪৪ নং অনুচ্ছেদে উল্লিখিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান। মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – সাম্য, চলাফেরা, সভা-সমিতি, চিন্তা ও বিবেকের অধিকার, বাকস্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার ইত্যাদি। সংবিধানের ১০২ নং অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারসমূহ বলবত করার নিমিত্তে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে।
সংসদীয় পদ্ধতির সরকার
১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাদেশের জন্য সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রবর্তন করা হয়। এতে বলা হয়, রাষ্ট্রপ্রধান হবেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান এবং মন্ত্রিপরিষদসহ প্রধানমন্ত্রী হবেন প্রকৃত শাসক এবং সরকারপ্রধান। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ একক এবং যৌথভাবে জাতীয় সংসদের নিকট দায়ী থাকবেন। জাতীয় সংসদ সমস্ত ক্ষমতার উতস।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
১৯৭২ সালের সংবিধানের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা নিশ্চিত করা হয়। সংবিধানের ২২ নং অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে একটি সর্বোচ্চ আদালত স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়। বলা হয় এর নাম হবে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টকে নাগরিক অধিকার রক্ষা করা এবং সংবিধানের প্রাধান্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল
১৯৭২ সালের সংবিধানে সাধারণ বিচার বিভাগ ছাড়াও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, বরখাস্ত, দণ্ড ও কর্মের মেয়াদ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ ও সম্পত্তি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বিধিসমূহের ওপর প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালকে এখতিয়ার দেওয়া হয়। এসব ব্যাপারে সাধারণ আদালতের কোনো এখতিয়ার ছিল না।
উপসংহার: বাংলাদেশ সংবিধানের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্য ছাড়াও আরও নানাবিধ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন – সংশোধনী, মালিকানার নীতি, এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র, এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র, ন্যায়পাল পদ সৃষ্টি, সর্বজনীন ভোটাধিকার ইত্যাদি। এসব অনন্য বৈশিষ্ট্যের দরুনই বাংলাদেশের সংবিধানকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান বলা হয়।