২৬ মার্চ ১৯৭১ এর ইতিহাস
[ad_1]
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দান করে। সকল সৃষ্টির ওপর মানুষের মর্যাদাকে তিনি বলবত করেছেন তাকে খলীফাতুল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবী নামক গ্রহে প্রেরণ করে।
মানুষ যাতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে সেজন্য তিনি বিধান দিয়েছেন ওহীর মাধ্যমে, এজন্য যুগে যুগে নবী-রসূল পাঠিয়েছেন। এবং তাঁদের নিকটই ওহী বা প্রত্যাদেশ নাযিল করেছেন। নবী-রসূলগণ মানুষকে আল্লাহর দেয়া প্রত্যাদেশ অনুযায়ী সৎপথের দিশা দিয়েছেন।
সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হচ্ছেন হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা আহমদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। তাঁরই মাধ্যমে আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থা ইসলামের পূর্ণতা আনে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ মুতাবেক ১০ হিজরীর ৯ জিলহজ শুক্রবার আরাফাত ময়দানে ১ লাখ ৪০ হাজার হজ পালনরত সাহাবীর বিশাল সমাবেশে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের বিদায় হজের খুতবা প্রদান করা।
আল্লাহর বিধান অনুযায়ী যে মানুষ পৃথিবীর জীবনকে আলোকিত করতে পারে সেই মানুষ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। মানুষকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু যেমন স্বাধীন সত্তা দিয়েছেন তেমনি তাকে স্বাধীনতার সুফল লাভ করার এখতিয়ার দিয়েছেন। আল্লাহর দেয়া স্বাধীনতা অনাচার, পাপাচার, স্বেচ্ছাচার, স্বৈরাচার, ভ্রষ্টাচার ও দুর্বৃত্তায়নকে প্রশ্রয় দেয় না, বরং ওগুলোর সমস্ত দরজা রুদ্ধ করে দিয়ে মানবিক মূল্যবোধের বৃত্তের আওতায় নীতি ও নৈতিকতার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির দুনিয়া গড়ার তাকীদ দেয়, সে স্বাধীনতা আল্লাহর হক আদায়ের পাশাপাশি বান্দার হক আদায়ের পাশাপাশি বান্দার হক আদায়ের সমান গুরুত্ব দেয়, শ্রেণী বিভক্ত সমাজব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে মানুষে মানুষে বৈষম্য দূরীভূত করে।
কোন অনারবের ওপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন আরবের ওপর কোন অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন সাদার ওপর কোন কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন কালোর ওপর কোন সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে।
সেই খুত্বার শুরুতেই তিনি সবাইকে সম্বোধন করে বলেন, আজকের এই দিনটির (হজের দিন) মতো, এই মাসটির (জিলহজ মাস) মতো, এই জনপদের (মক্কা মুকাররমা) মতো তোমাদের একের ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত, রক্ত তোমাদের পরস্পরের নিকট অলঙ্ঘনীয় পবিত্র।
আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি ইসলামই প্রকৃত স্বাধীনতার মহাসড়ক নির্মাণ করেছে। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আইয়ামে জাহিলিয়াতের নিকষ কালো অন্ধকারে ধুঁকে ধুঁকে মরণাপন্ন মানবতাকে উদ্ধার করে মুক্তির সুখসাগরে অবগাহন করান। গুটি কয়েক সমাজপতির কব্জায় জিম্মি হয়ে বন্দীদশাপ্রাপ্ত মানবতাকে তিনি স্বাধীনতার আস্বাদন দান করেন। নারী মুক্তির প্রশস্ত পথ উন্মোচিত করেন, ক্রীতদাস প্রথার শেকড় পর্যন্ত উপড়িয়ে ফেলেন, কাফ্রি গোলাম
তিনি মদীনা মনওয়ারায় ৬২২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস মুতাবিক রবিউল আউয়াল মাসে আপন জন্মভূমি মক্কা মুকাররমা ত্যাগ করে হিজরত করে এসে এখানে একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের বুনিয়াদি কাঠামো সংস্থাপন করেন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা মদীনার সনদ বা ‘চার্টার অব মদীনা’ নামে পরিচিত। একে ‘চার্টার অব লিবার্টিও’ বলা হয়। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। এই শাসনতন্ত্রে সর্বস্তরের, সর্ব ধর্মের এবং সকল বর্ণের মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং মদীনা রাষ্ট্রকে রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
এই স্বাধীন মদীনা রাষ্ট্র তাঁর সময়েই ইয়ামেন থেকে দামেস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এবং এরই মাধ্যমে রাজতন্ত্রের শেকড় উৎপাটিত হয়ে স্বাধীনতার সুবাতাস প্রবাহিত হতে থাকে।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই মানুষ তাদের মরুভূমিতে বিচরণ করে বেড়াত। সেই তাদের কাছে আবির্ভূত হলেন একজন বীর নবী একটি কালাম নিয়ে, যা তারা বিশ্বাস করল, দেখ! যারা ছিল অজ্ঞাত তারা হয়ে গেল জগতখ্যাত, যারা ছিল নগণ্য তারাই হয়ে উঠল বিশ্বজুড়ে শ্রেষ্ঠ। একশ’ বছর যেতে না যেতেই আরব বিস্তৃত হলো গ্রানাডা পর্যন্ত এদিকে, আর ওদিকে দিল্লী পর্যন্ত।
ইসলাম ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে বাকস্বাধীনতার বহু নজির রয়েছে। এক জুমআর দিনে ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু মসজিদুন্নববীতে জুমআর খুতবা দেবার জন্য যেই মিম্বারে উঠেছেন অমনি এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন : খলীফা! আমার একটা জিজ্ঞাসার জবাব না দিয়ে আপনি খুতবা দিতে পারবেন না। প্রবল প্রতাপশালী খলীফা ফারুক আজম হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু কোনরূপ রাগান্বিত না হয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন : ভাই, তুমি কি জানতে চাইছ? লোকটি বললেন : এবার বায়তুল মাল থেকে যে কাপড় বণ্টন করা হয়েছে তা দিয়ে আমাদের জামা লম্বা করা সম্ভব হয়নি। আমরা যতটুকু কাপড় পেয়েছি আপনারও তো ততটুকু কাপড় পাওয়ার কথা, অথচ আপনার পরিধানে যে জামা রয়েছে তা লম্বা তো বটেই, তাছাড়াও আপনার জামার আস্তিনও লম্বা।
আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু মানুষকে সৎ চিন্তা করার স্বাধীনতা দিয়েছেন, ন্যায্য কথা বলার স্বাধীনতা দিয়েছেন, সৎ পথে উপার্জন করার স্বাধীনতা দিয়েছেন, সুন্দর জীবন গড়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। মানুষকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু স্বাধীনতা নামক যে খাস নি’আমত দান করেছেন তাকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে লালন করারও বিধান দিয়েছেন। মানুষকে পানাহার করার স্বাধীনতা তিনি দিয়েছেন, সেইসঙ্গে হালাল ও পবিত্র জিনিস গ্রহণের এবং হারাম ও অপবিত্র জিনিস বর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন।
ইসলামে স্বাধীনতা হচ্ছে সৎ চিন্তার বিকাশ ঘটানো, সুন্দর পবিত্র জীবনযাপন ও মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখা। স্বাধীনতা মানে যথেচ্ছা জীবনযাপন করা নয়। স্বাধীনতা হচ্ছে সুশৃঙ্খলার মধ্যে থেকে দেশপ্রেমকে অন্তরে ধারণ করে অবাধে, নির্বিঘ্নে এবং সুখ-শান্তিতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, ভৌগোলিক নিজস্ব সীমানায় সম্মিলিত প্রয়াসে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে ঐক্য ও সংহতির বাতাবরণ গড়ে তোলা।
ইসলাম স্বাধীনতার যে চেতনা সঞ্চারিত করে তা সমগ্র মানবজাতিকে একই সমতলে এনে দাঁড় করিয়ে একটি সুখী-সুন্দর জীবনের দিকে চালিতে করে।
আজ ১৬ ডিসেম্বর, আমাদের বিজয় দিবস। বিজয়ের আনন্দে পুরো জাতি আজ উদ্ভাসিত। এদিন মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় দেশের স্বাধীনতা। মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এ বিজয় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। স্বাধীনতার ইসলামি স্বরূপ হচ্ছে মানুষ মানুষের গোলামি করবে না। মানুষ একমাত্র তার সৃষ্টিকর্তার গোলামি করবে। আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু, দিতে হয়েছে লাখ লাখ প্রাণের তাজা রক্ত। আল্লাহপাক পরাধীনতা পছন্দ করেন না। স্বাধীন ভূখ- যেখানে নেই, সেখানে ধর্ম নেই আর যেখানে ধর্ম নেই, সেখানে কিছুই নেই। তাই ইসলামে স্বাধীনতার গুরুত্ব অতি ব্যাপক।
সৃষ্টির প্রতিটি জীব স্বাধীনতা পছন্দ করে। পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি বা জীব পাওয়া যাবে না, যারা পরাধীন থাকতে চায়। তাই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সবাই কতই না চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে থাকে। আর এই স্বাধীনতার জন্যই মহানবী (স) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে পরবর্তী সময়ে মক্কাকে করেছিলেন স্বাধীন। ইসলামের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত নবীর আগমন হয়েছে, তারা সবাই সমাজ, দেশ ও জাতির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন আর এই স্বাধীনতা অত্যাচারী শাসকের দাসত্ব থেকে জাতিকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রেই হোক বা ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে হোক। এক কথায় বলা যায়, সব ধরনের দাসত্ব ও পরাধীনতা থেকে মুক্ত করাই হচ্ছে আল্লাহতাআলার প্রেরিত নবীদের কাজ।
ইসলাম স্বাধীনতাকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছে, তেমনি দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং একে ইমানের অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। স্বদেশপ্রেম মহানবী (স)-এর হৃদয়ে যেমন ছিল, তেমনি তার সাহাবায়ে কেরামদের মাঝেও বিদ্যমান ছিল। তিনি (স) মক্কা থেকে মদিনার পথে হিজরতের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে তার মুখ ফেরালেন জন্মভূমি মক্কার দিকে আর তার যেখানে তিনি নবুয়ত লাভ করেছেন এবং তার পূর্বপুরুষরা বসবাস করে আসছেন।
মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, এমনকি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বাধীনতার চেতনাকে জাগ্রত করে প্রিয় নবী (স) মানুষ হিসেবে তাদের নিজের পরিচয়, সম্মান, আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি যেমন অসংখ্য দাসকে নিজ খরচে মুক্ত করেছেন, তেমনি সারা বিশ্বকে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ। আল্লাহপাকের কাছে এ কামনা করি, আমাদের যেন আবার দাসত্বের জীবনে জড়িয়ে পড়তে না হয়। নিজ দেশের প্রতি, দেশের সম্পদের প্রতি আমাদের অনেক বেশি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে। আল্লাহপাক আমাদের সেই তৌফিক দান করুন।
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার।
ইসলামে যে স্বাধীনতার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সেটা স্ব-অধীনতা অর্থে ব্যবহৃত হলেও তা স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা স্বৈরতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দেয় এবং সে স্বাধীনতা ব্যক্তির স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সমষ্টির স্বাধীনতা সুসংহত করে।
পৃথিবীতে যুগে যুগে এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রসূল এসেছেন সত্য-সুন্দর পথের দিকে আহ্বান করার জন্য। তারা মানুষকে সৎপথের দিশা দিয়েছেন, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই- তওহীদের এই বাণী প্রচার করেছেন, আল্লাহর রবুবিয়ত প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের কথা বলেছেন, জীবনের পরতে পরতে মানুষ যাতে মনুষ্যত্বকে আত্মস্থ করতে পারে সে জন্য সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন, মানবিক মূল্যবোধ কোথায় কোথায় নিহিত রয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরেছেন, বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীনের প্রতি সামগ্রিকভাবে অনুগত থাকবার কথা বলেছেন, মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করছেন।
আমরা ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে আগমনের প্রাক্কালের যে যুগটা চলছিল তাকে বলা হতো আইয়ামে জাহিলিয়াত বা অন্ধকার আর অজ্ঞতার যুগ। তখন মানবতা জিম্মি হয়ে গিয়েছিল গুটিকয়েক সমাজপতির হাতে। হানাহানি, কাটাকাটি, খুনোখুনী লেগেই থাকত কোন ব্যক্তি বা কোন গোষ্ঠীর আভিজাত্য ও প্রাধান্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য, যে কারণে বৃহৎ জনগোষ্ঠী বা সাধারণ জনগণ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। মানুষ যে আল্লাহর সেরা সৃষ্টি-আশরাফুল মাখলুকাত- এই সত্যটির স্বীকৃতি ছিল না। স্বাধীনতা নামক প্রতিবেশের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
ইসলাম ঘোষণা করল সব মানুষের সমঅধিকারের কথা, প্রত্যেকের স্বাধীনতার কথা। পরাধীনতা ও দাসত্বের কবল থেকে ইসলাম মানবতাকে উদ্ধার করল। এর জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সঙ্গী-সাথীগণকে অকথ্য জুলুম-নির্যাতনের মোকাবেলা করতে হয়েছে, এমনকি প্রিয় জন্মভূমি মক্কা মুকাররমা থেকে হিজরত করে মক্কা থেকে ২৯৬ মাইল উত্তরে মদিনা মনওয়ারায় চলে যেতে হয়েছে। মক্কা ত্যাগকালে তিনি কাবা শরীফের দিকে তাকিয়ে মক্কা নগরীকে সম্বোধন করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন; হে আমার জন্মভূমি মক্কা, আল্লাহর এই বিশাল পৃথিবীতে তুমিই আমার কাছে সবচেয়ে পবিত্র এবং প্রিয়। কিন্তু তোমার সন্তানেরা আমাকে তোমার কোলে থাকতে দিল না, তাই আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি। কাঁদতে কাঁদতে বার বার তিনি চোখের পানি মুছছিলেন।
প্রিয়নবী (সা) ১৫ দিন লোকচক্ষু এড়িয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুকে সঙ্গে করে মদিনার উপকণ্ঠ কুবা নামক স্থানে উপস্থিত হলে প্রায় পাঁচ হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরীর এক বিশাল জনতা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে তালাআল বাদরু আলায়না/মিন ছানিয়াতিল বিদাঈ/ওয়াজাবাশ শুকরু আলায়না/মাদাআ লিল্লাহি দা’ঈ- সুললিত সমবেত উচ্চারণে খোশ আমদেদ জানান। মূলত তদানীন্তন ইয়াসরীব যা প্রিয়নবী (সা)-এর আগমনের ফলে মদিনাতুন নবী বা মদিনা মনওয়ারা নামে পরিচিত হয় তা একটা দীর্ঘকালীন নৈরাজ্যজনক অবস্থা থেকে মুক্তি পেল।
মদিনার মানুষ মদিনার দুই শক্তিশালী গোত্র বনু আউস এবং বনু খায়রাযের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে যে যুদ্ধ চলে আসছিল সেই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অন্য গোত্রগুলোও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, যে কারণে এই যুদ্ধ ব্যাপক আকার ধারণ করার কারণে মদিনাবাসীর কয়েক নেতা মক্কা মুকাররমায় হজের মৌসুমে গিয়ে গোপনে আকাবা নামক স্থানে প্রিয়নবী (সা)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদিনায় যাবার জন্য তাকে দাওয়াত দেন। মদিনার বিবদমান বনু খায়রায ও বনু আউসের উভয় গোত্রের বিদগ্ধজনরা চাইছিলেন তাদের নগরীতে এমন এক মহান ব্যক্তির আগমন ঘটুক যিনি তাদের অঞ্চলে এসে সব দ্বন্দ্ব-কলহ ও অশান্তির অবসান ঘটাবেন।
তারা প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মধ্যে তাদের সেই কাঙ্খিত মহামানবের নিদর্শন দেখতে পেয়েছিলেন। প্রিয়নবী (সা) আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে সেখানে হিজরত করেন। মদিনা মনওয়ারায় এসে এখানে তিনি একটি মসজিদ স্থাপন করেন যা মসজিদুন নববী নামে মশহুর হয় এবং এই মসজিদকেন্দ্রিক এক স্বাধীন নগররাষ্ট্রের পত্তন করেন যা কয়েক বছরের মধ্যে এক অনন্য কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে বিস্তৃত হয় ইয়ামন থেকে দামেস্ক পর্যন্ত। পরবর্তী এক শ’ বছরের মধ্যে তা দিল্লী থেকে গ্রানাডা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
প্রিয়নবী (সা) যে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন তা পরিচালনার জন্য মদিনার ইয়াহুদীসহ অন্যান্য সম্প্রদায় ও গোত্রের নেতৃবৃন্দের সম্মতি নিয়ে তিনি একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করলেন- যাতে সবাই স্বাক্ষর করল। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। মদিনার সনদ বা চার্টার অব মদিনা নামে পরিচিত এই সনদকে বিশ্বমানব ইতিহাসে প্রথম লিখিত চার্টার অব লিবার্টি বা স্বাধীনতা সনদও বলা হয়। সকল মতাবলম্বীকে এই সনদে চিন্তার স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা দেয়া হয়। এই সনদের মাধ্যমে একটি রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ইয়াহুদীদের জন্য তাদের ধর্ম, মুসলিমদের জন্য তাদের ধর্ম (দীন)।
… ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই একই গোষ্ঠীভুক্ত বলে গণ্য হবে। কারও মধ্যে কোন মতানৈক্য হলে আল্লাহ এবং তার রসূল মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সমীপে তা পেশ করতে হবে।
… এই সনদের আওতাভুক্ত কোন ব্যক্তি বা গোত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক বা বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজে লিপ্ত হতে পারবে না, এই জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত কেউ হযরত মুহম্মদ (সা)-এর বিনা অনুমতিতে কোন যুদ্ধাভিযানে যেতে পারবে না।
… এই সনদের আওতাভুক্ত সবার নিকট ইয়াসরিব (মদিনা) উপত্যকা অত্যন্ত পবিত্র স্থান।
… এই সনদের অন্তর্ভুক্ত লোকদের মধ্যে যেসব বিবাদ-বিসংবাদ অথবা ঝগড়া-ফ্যাসাদ সাধারণভাবে মীমাংসা করা সম্ভব হবে না, তার মীমাংসার ভার আল্লাহ ও তার রসূল হযরত মুহম্মদ (সা)-এর ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
…কুরায়শ ও তাদের সাহায্যকারীকে আশ্রয় (তুজার) দেয়া যাবে না। ইয়াসরিব সহসা আক্রান্ত হলে এই সনদের আওতাভুক্ত সবাই শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে।
৪৭ শর্তবিশিষ্ট এই সনদের আওতাভুক্ত ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে প্রিয়নবী (সা)-কে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, শাসনকর্তা, প্রধান বিচারক, সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে গ্রহণ করে। এই স্বাধীনতা সনদে শান্তির পরিপন্থী কার্যকলাপকে দ-নীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সনদে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপ বিভাসিত হয়ে উঠেছে এবং মানুষে মানুষে বিভাজনের বিরুদ্ধে এবং অন্যায়, অরাজকতা, সন্ত্রাস, বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে দেশে অশান্তি সৃষ্টি করার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াবার নির্দেশনা উদ্দীপ্ত হয়েছে। ইসলাম ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতাও দিয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে এর ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে।
ইসলামে স্বাধীনতার গুরুত্ব সীমাহীন। ইসলাম স্বাধীনতার প্রতি শুধু উদ্বুদ্ধই করে না, বরং স্বাধীনতা অর্জন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবনদানকে শাহাদাতের মর্যাদা প্রদান করে। স্বাধীনতা যে কত গুরুত্বপূর্ণ এক নিয়ামত, পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধরাই কেবল তা অনুধাবন করতে পারে। পরাধীনতা মানুষকে আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য অর্জনের পথে অনেক বড় বাধা সৃষ্টি করে। পরাধীন মানুষ কখনো একান্তে বসে আল্লাহর ইবাদত করতেও সক্ষম হয় না। তা ছাড়া স্বাধীনতা মানুষের মধ্যে সত্য-সুন্দরের বোধ তৈরি করে এবং তাদের মহান সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যে সমর্পিত হওয়ার প্রেরণা দেয়।
স্বাধীনতা মহান আল্লাহর অপূর্ব দান। স্বাধীনতার জন্য শোকর আদায় করে শেষ করা যায় না। স্বাধীনতার মর্যাদা সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে তার আমল আর বৃদ্ধি পেতে পারে না।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগে রাসুল (সা.) মদিনাকে স্বাধীন করেছিলেন সুদখোর, চক্রান্তবাজ, ইহুদিদের কবল থেকে। তিনি (সা.) ছিলেন ইতিহাসের একজন মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক। ইসলাম মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জোরালো তাগিদ দিয়েছে বলেই মহানবী (সা.) এমনটি করেছেন। উল্লেখ্য, রাসুল (সা.) হিজরত করার পর মদিনাকে নিজের মাতৃভূমি হিসেবে গণ্য করেন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার জীবনের অনেক প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিল মদিনা রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য।
মদিনায় হিজরতের পরেও কিছুসংখ্যক মুসলিম নারী ও শিশু মক্কায় অবস্থান করতে বাধ্য হন, যাদের হিজরত বা দেশ ত্যাগ করার কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তারা মূলত মক্কায় পরাধীন অবস্থায় নির্যাতিত জীবন যাপন করছিলেন। তখন তারা এ মর্মে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছিলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এই জনপদ, যার অধিবাসী জালিম, তা থেকে আমাদের অন্যত্র নিয়ে যাও; তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক করো এবং তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের সহায় করো।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত : ৭৫) অতঃপর ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে মক্কা বিজয় হয়। স্বাধীনতাকামী মজলুমদের আকুল প্রার্থনা মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে মানবসমাজ থেকে অন্যায়ের মূলোৎপাটন করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান। সব ধরনের শোষণ, নির্যাতন, অন্যায় ও অবিচারের মূলে রয়েছে জুলুম। পরাক্রমশালী শত্রুর অত্যাচার ও পরাধীনতার শৃঙ্খল অন্যায়ের দ্বারা ব্যক্তির স্বাধিকার হরণ করা হয় এবং পরাধীনতা জুলুমের ক্ষেত্র প্রসারিত করতে সাহায্য করে। অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং জুলুমের অবসান ঘটানো ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মাতৃভূমি রক্ষার জন্য আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, ইসলামের দৃষ্টিতে তারাও শহীদ। কারণ, দেশের জন্য, দেশপ্রেম হৃদয়ে নিয়ে মজলুম জনতার দাবি আদায়ের স্বার্থে লড়াই করা আল্লাহর পথে লড়াই করারই নামান্তর।
মানবজীবনে সার্বভৌম রাষ্ট্র অতীব প্রয়োজনীয়। স্বাধীন রাষ্ট্র ছাড়া সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত সমাজ বা জনগোষ্ঠী তৈরি করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ইতিহাসে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ, মুক্তিসংগ্রাম, গণ-আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ বা কঠিনতম কর্মের মধ্যে আত্মদানকারী অসংখ্য দেশপ্রেমিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মহান নেতার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এ ক্ষেত্রে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাতবরণকারীদের জন্য, পবিত্র কোরআন খতম, দোয়ার আয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নামে কল্যাণধর্মী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। যেমন শহীদদের সম্মানে শিশু নিকেতন, বৃক্ষরোপণ, মসজিদ নির্মাণ ইত্যাদি সেবামূলক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তাদের আত্মার শান্তির জন্য বিশেষভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে আমাদের প্রার্থনা করতে হবে।
চিন্তার অধিকার মানুষের একটি স্বভাবজাত অধিকার। একজন মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে। সব মানুষই যেকোনো বিষয়ে ভাবতে, গবেষণা করতে পারে। ইসলাম মানুষের এই স্বাধীনতার ওপর কোনো জোরজবরদস্তি করে না। কারণ, ইসলাম হলো ফিতরাতের এক জীবনব্যবস্থার নাম। ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রেও চিন্তা করার সুযোগ রয়েছে। দেখে, শুনে ও বুঝে তবেই ইসলাম গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। হজরত সালমান ফার্সি (রা.) ইসলাম গ্রহণের আগে নানা মতবাদের দীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, চিন্তা-ফিকির ও গবেষণা করেছেন। সর্বশেষ রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে হাত রেখে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) কারো ওপরই জোর খাটাননি, বাধ্য করেননি।
কালো-সাদা, আরব-অনারব, পরাধীন-ক্রীতদাস রূপে কেউ জন্মলাভ করে না। বরং জন্মগ্রহণকারী শিশুর একটাই পরিচয়, সে মানুষ। মানুষ হিসেবে একটি স্বাধীন শিশু হয়েই সে পৃথিবীতে আসে। মানুষ তাকে পরাধীনতার জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে। হজরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘তোমরা কবে থেকে তাদের ক্রীতদাস বানিয়েছ, অথচ তাদের মায়েরা তো তাদেরকে স্বাধীন হিসেবেই জন্ম দিয়েছে!’
স্বাধীন থাকা, স্বাধীনভাবে চিন্তা করা, স্বাধীনভাবে ভাবার অধিকার শিশুর জন্মগত। এই অধিকার হরণের অবকাশ নেই।
ক্রীতদাসমুক্ত সমাজ নিজেদের চোখে বিনির্মাণের এক স্বপ্নময় অধ্যায় প্রত্যক্ষ করেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম (রা.)। এ কারণে নবীজির সহচরগণ সারা জীবন মানবতার সর্বতো কল্যাণে কাজ করে গেছেন। তাদের ধারাবাহিকতায় অলিআল্লাহ, গাউস-কুতুব এবং ওলামায়ে কেরাম মানবতার মুক্তির জন্য মানুষের স্বাধীন মতামতের ওপরই কার্যত অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন।
মতপ্রকাশ এবং স্বাধীন চিন্তা ব্যক্ত করার অধিকার সবার থাকলেও কখনোই সীমালঙ্ঘনকে ইসলাম সমর্থন করে না। কারো ওপর কটাক্ষ করার যৌক্তিকতা নেই। কাউকে উসকে দিয়ে কোনো স্বার্থ হাসিলেও উৎসাহিত করে না। পবিত্র কুরআনে আছে, ‘লিমা তাকুলূনা মা লা-তাফ্আলূন’ অর্থাৎ, ‘তোমরা কেন এমন কথা বলো, যা তোমরা করো না।’
ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বরূপ
ইসলামে কোনো বাড়াবাড়ি নেই। ধর্ম নিয়ে কোনো রেষারেষি নেই। ইসলাম সমতা ও সাম্যের জীবনব্যবস্থার নাম। ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শান্তি, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বপরায়ণ এক রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন মদিনায়। মদিনার অন্যান্য ধর্মীয় বেত্তার সঙ্গে যে শান্তিচুক্তি করেছিলেন, তা এখনো ‘মদিনা সনদ’ নামে পৃথিবীখ্যাত হয়ে আছে। মদিনার সংবিধানের কোনো না কোনো পয়েন্ট পৃথিবীর তাবৎ সংবিধান রচনায় কাজে লেগেছে।
ইসলাম মানতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। কোনোকিছুর প্রলোভন দেখিয়েও কাউকে ইসলামে টানা যাবে না। কেবল স্বেচ্ছায়, বুঝেশুনে, সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবেচিন্তে ইসলামে আত্মসমর্পণ করলেই মুসলমান হবে। মানুষের বিশ্বাসকে ইসলামে অবমূল্যায়ন করা হয়নি।
ইসলাম কোনো চাপাচাপির জায়গা নয়-
‘(হে নবী) আপনার মালিক চাইলে এই জমিনে যত মানুষ আছে, তারা সবাই ইমান আনত। (কিন্তু তিনি তা চাননি, তাছাড়া) আপনি কি মানুষকে জোরজবরদস্তি করবেন, যেন তারা সবাই মুমিন হয়ে যায়!’ (সূরা ইউনুস, আয়াত- ৯৯)
মক্কায় নবীজির ওপর এ রকম আয়াত হয়েছে। নবীজি (সা.) চাইতেন, মক্কার আবু জেহেল এবং উমরসহ সবাই ইসলামের আলোকে আলোকিত হোক। সত্য ও সমৃদ্ধির পথে মানুষকে নিয়ে আসতে নবীজি যারপরনাই চেষ্টা করতেন। মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরত করার পর আরো
কুরআনের চমকিত এই ঘোষণায় মুসলমানরা যেন থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। মানবতার নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) জোরজবরদস্তি করা যাবে না দিয়ে যার যার ধর্ম পরিপালনে অসাম্প্রদায়িক এক মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এই মতপ্রকাশে বিশ্ববাসীও নড়েচড়ে বসে। কারণ, তখন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য বলত, ‘হয় খিস্টান হও, নয় তো খুন হও।’ মুসলমানরা যখন ইহুদি মতবাদ থেকে নিজেদের সন্তানদের জোর করে ইসলামে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। তখনই আল্লাহর রাসূল (সা.) ধর্মীয় স্বাধীনতার এই ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আজ ধর্ম নিয়ে তো নতুন করে বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই। এটা ইসলামেরও কোনো বিধান নয়। তাই ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ, পালনে কোনো বাধা না দেওয়া ইসলামেরই নির্দেশনা।
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলীফা বা প্রতিনিধি করে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য লা মালিকা ইল্লাল্লাহ্-আল্লাহ্ ছাড়া কোন মালিক নেই। তিনি রব্বুল আলামীন-বিশ্ব জগতের রব। রব শব্দের অর্থ এক কথায় বলা যায় না। এই কারণে রব শব্দের অর্থ করা হয় স্রষ্টা, সংরক্ষক, বিবর্ধক, প্রতিপালক, নিয়ন্ত্রণকারী, বিধানদাতা, রিয্কদাতা, তত্ত্বাবধায়ক, সর্বশক্তিমান। সার্বভৌমত্ব একমাত্র তাঁরই। তিনি অদ্বিতীয়। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর সেরা সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ।
সেই মহান সৃষ্টিকর্তা খালিক মালিক আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে দান করেছেন জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক- বিবেচনা : দান করেছেন অন্যান্য সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব। তিনি মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহের স্বাধীনতা, পছন্দমতো ঘর-সংসার গড়ার স্বাধীনতা, সুন্দর জীবন গড়ার স্বাধীনতা, প্রকৃতি থেকে সুস্থ ও সৎ পন্থায় সম্পদ আহরণের স্বাধীনতা, জীবনের স্তরে স্তরে ক্রমবর্ধমান সমস্যা সমাধানের স্বাধীনতা, শত্রুতা নিরসন করে বন্ধুত্ব স্থাপনের স্বাধীনতা দিয়েছেন। মানুষের এই স্বাধীনতার নানামাত্রিক দিকের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ইসলাম স্বাধীনতা বলতে বুঝিয়েছে এটা কোন যথেচ্ছ জীবনযাপন করার নাম নয়। মানুষ অবাধে, নির্বিঘ্নে এবং সুখ-শান্তিতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, ভৌগোলিক নিজস্ব সীমানার মধ্য, আপন মজবুত গণ্ডির মধ্যে সম্মিলিত প্রয়াসে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে হায়াতুন্ দুন্য়া বা পার্থিক জীবন গড়ে তুলবে খালিক মালিক রব্বুল ‘আলামীনের দেয়া বিধান অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়। যে কারণে ইসলাম স্বেচ্ছাচারিতা এবং স্বৈর মানসিকতা সমর্থন করে না।
মানুষের ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ্র দান। মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতে যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন, যে শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমেই মনের ভাব বোধগম্য করে প্রকাশ করুক না কেন, সে কথা বলার শক্তি, সে শব্দমালা তৈরির ক্ষমতা আল্লাহ্রই দান। পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। একই অর্থসহ কথা ভিন্ন ভিন্ন শব্দ বা বাক্যে প্রকাশ করার এই যে বিস্ময়কর উপস্থিতি বিশ্বজুড়ে, তা আল্লাহ্রই দান।
মানুষকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু যে স্বাধীনতা নামক নিয়ামত দান করেছেন তাকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচর্যা করার বিধানও তিনিই দিয়েছেন। মানুষকে পানাহার করার স্বাধীনতা দিয়েছেন তার মানে এটা নয় যে, মানুষ যা ইচ্ছা তাই করবে, জীবিকা নির্বাহের জন্য, ধন-সম্পদ সঞ্চয়ের জন্য জুলুম নির্যাতনের পথ গ্রহণ করবে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য পেশীশক্তির অপব্যবহার করবে, ন্যায়-অন্যায় বিচার করবে না, হালাল-হারামের পার্থক্য নির্ণয় করবে না। ইসলামে স্বাধীনতা হচ্ছে সৎ চিন্তার বিকাশ ঘটানো, সৎকর্মের পথ করে দেয়া, সুন্দর পবিত্র জীবনযাপন ও মানবতার প্রসার ঘটানো, শান্তির দুনিয়া গড়ে তোলা।
এই আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট আইয়ামে জাহিলিয়াতের সেই র্শিক, কুফর, কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাস জর্জরিতকাল হলেও, সেই সরদারশাসিত শতধাবিভক্ত কাল হলেও এর মধ্যে সেই অন্ধকার কাল থেকে আল্লাহ্র মেহেরবাণীতে মুক্তি পাবার কথা বলা হয়েছে। আর এই স্বাধীনতার আলোকচ্ছটার যে ইশারা এতে বিধৃত হয়েছে তা সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। এখানে যে আগুনের কুয়োর কথা বলা হয়েছে, যে অগ্নিকু-ের উল্লেখ করা হয়েছে তার দ্বারা মানুষের প্রকাশ্য দুশমন শয়তান প্ররোচিত সমাজকে বোঝানো হয়েছে, পরাধীনতার ভয়াবহ চেহারা অগ্নিকু- এই উচ্চারণের মাধ্যমে প্রকটভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আমরা জানি ইসলাম প্রকৃত স্বাধীনতার কথা বলে। আইয়ামে জাহিলিয়াতে শুধু আরব সমাজেই নয়, জগতজুড়ে মানবতা এক মারাত্মক হুমকির মধ্যে নিপতিত ছিল। ক্রীতদাস প্রথা এমন মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল যে, গরু-ছাগাল, উট-মহিষ, মেষ-দুম্বার মতো মানুষও হাটে-বাজারে বিক্রি হতো, নারী সমাজের মর্যাদা একেবারে ছিল না, তারা সাধারণ পণ্যসামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের আত্মাহীনা, শয়তানের ফাঁদ, ছলনাময়ী প্রভৃতি নানা বদনামে ভূষিত করা হয়েছিল, মদ্যপান, সুদ, লুণ্ঠন, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া, গুম, খুন, হত্যা, রাহাজানি, কল্পনাপ্রসূত দেব-দেবী, কাঠ-পাথর-মাটি দিয়ে বানিযে সেগুলোর পূজা করা প্রভৃতি মানবতাকে এক করুণ ও অপমানজনক অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। আইনের শাসন বলতে কোথাও কিছু ছিল না, মানবিক মূল্যবোধ বলতে কোথাও কিছু ছিল না. সর্বত্র বিরাজ করছিল নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য। স্বাধীনতা কল্পনাতীত বিষয়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে ইসলামের শান্তির বাণী, স্বাধীনতার বাণী নিয়ে আবির্ভূত হলেন হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম। তিনি আল্লাহ্র দেয়া পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা আল ইসলামের দিকে সবাইকে আহ্বান করলেন। তিনি সর্বস্তরের মানুষকে, নারী-পুরুষ সবাইকে একটি সুসংহত স্বাধীন সত্তা বিকাশের দিকে পরিচালিত করলেন।
এই ফিত্রত বা প্রকৃতিই মানুষের স্বাধীন সত্তার পরিচয় বহন করে। এই স্বাধীনতাকে হরণ করা, ক্ষুন্ন করা কিংবা কারও স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার অধিকার ইসলাম দেয় না, তবে স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যা ইচ্ছা তা-ই করা যাবে, অন্যের সম্পদ গায়ের জোরে আত্মসাত করা যাবে, বিনা অপরাধে কাউকে হত্যা করা যাবে, বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা যাবে, দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করা যাবে।
স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব একটি অমূল্য সম্পদ এবং আল্লাহর এক মহানিয়ামত। একে রক্ষা করার জন্য যারা সীমান্ত প্রহরায় থাকে কিংবা এর হিফাজতের জন্য সর্বস্তরের মানুষে নিজেদের গরজে এবং জনস্বার্থে দেশ গঠনমূলক কাজে ব্যাপৃত থাকে তাদের জন্যও রয়েছে অশেষ পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি।
সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার, চুরি, রাহাজানি, ছিনতাই এসবই স্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকের নিকট পেশ করো না। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৮)।
স্বাধীনতা মানুষের সুখী জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে, তবে ইসলাম যা হারাম করেছে, যা পানাহার করতে নিষেধ করেছে তা করার স্বাধীনতা ইসলাম দেয় না।
ইসলাম পরনিন্দা, পরচর্চা, কারও বাড়িতে বা জমিতে জোর করে অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কর্ম করার স্বাধীনতা দেয় না।
মহান আল্লাহ হজরত আদম (আ.)-কে প্রেরণের আগে বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীতে খলিফা তথা প্রতিনিধি পাঠাব।’ সব নবী-রসুল নিজ জন্মভূমি ও দেশকে ভালোবাসতেন। স্বদেশের জন্য গভীর টান ও মায়া-মমতা প্রকাশ পেয়েছে হজরত নূহ (আ.), হজরত ইবরাহিম (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.), হজরত মূসা (আ.) সহ অনেক পয়গাম্বরের জীবন ও আচরণে।
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জন্মভূমি ফিলিস্তিনের হেবরনে। আল্লাহ-প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করতেন। কাজ শেষে নিজ দেশে ফিরে আসতেন। পবিত্র কাবাগৃহ পুনর্নির্মাণ, ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানি, মক্কাকেন্দ্রিক দাওয়াত প্রচারের জন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি সপরিবারে যখন মক্কায় বাস করতেন তখন তার চিন্তা-চেতনা ও দোয়া-প্রার্থনায় এই জনপদের প্রতি গভীর আগ্রহ, প্রেম ও ভালোবাসা ব্যক্ত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারায় তার এমন একটি দোয়ার কথা উল্লেখ আছে যখন ইবরাহিম (আ.) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! এই নগরীকে নিরাপদ রাখুন এবং এই অধিবাসীদের ফল-ফসল থেকে রিজিক দান করুন, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে।’
ইসলামের ইতিহাস পাঠে আমরা দেখতে পাই, পূর্বসূরি মনীষীরা স্বদেশ ও স্বজাতিকে নিজের সন্তান-পরিজনের মতো ভালোবাসতেন। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার পরিবারের অনেক সদস্য, ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.), মুহাম্মদ বিন কাসিম, সাইয়েদ আহমদ শহীদ, ইসমাইল শহীদ, মীর নিসার আলী তীতুমির, টিপু সুলতানসহ অসংখ্য মুসলিম নেতা দেশের স্বাধীনতা, মানুষের ধর্মীয় ও জাগতিক অধিকারের জন্য জীবন দান করে গোটা উম্মতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আরবিতে একটি বাণী স্বতঃসিদ্ধ আছে ‘হুব্বুল ওয়াতান মিনাল ইমান’। দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। জন্মভূমি মক্কা মুকাররমার প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অপরিসীম ভালোবাসার কথা কে না জানে।
তাকে যখন প্রতিপক্ষের প্রভাবশালী লোকেরা হিংস্রতা ও চরম নিষ্ঠুরতায় মক্কা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করল, তিনি পবিত্র মদিনার উদ্দেশে যাচ্ছিলেন তখন পেছন ফিরে প্রিয় মাতৃভূমির দিকে তাকাচ্ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হে মক্কা! প্রিয় জন্মভূমি আমার! যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বাধ্য না করত আমি কোনো দিন তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ দায়িত্বের চাপে অনেক মানুষ পরদেশে গিয়েছেন বা জীবন অতিবাহিত করেছেন, কিন্তু নিজ দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য পালনে কখনো উদাসীন ছিলেন না।
আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে মহান ব্যক্তিদের জীবনদান ও ভালোবাসার মাধ্যমে। দেশ গঠন, এর উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য চিন্তা, পরিকল্পনা ও কাজ করা আমাদের দায়িত্ব। এজন্য দেশপ্রেমের বিকল্প নেই। প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ স্থান থেকে দেশের কল্যাণ, নিরাপত্তা ও সুনামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য ত্যাগের মানসিকতা অর্জন করতে হয়। আর এই মানসিকতা সৃষ্টির অন্যতম উপাদান হলো স্বদেশপ্রেম।
মানুষ ও দেশের স্বাধীনতা একটি কাঙ্ক্ষিত ও কাম্য বিষয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে স্বাধীন হয়। মহান আল্লাহ ভূখণ্ডগুলোকে স্বাধীনরূপে সৃষ্টি করেছেন। তিনি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে নির্দিষ্ট জনগণকে পাঠিয়েছেন। সুতরাং অন্যের প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে সেখানে বসবাস এবং যাবতীয় জীবনোপকরণ ভোগ-ব্যবহার করা তাদের জন্মগত অধিকার। যেখানে অন্য কারও হস্তক্ষেপ অন্যায়, অপরাধ ও জুলুমের শামিল।
আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয়। তরতাজা রক্ত ও বহু প্রাণের বিনিময়ে এটি স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এর উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য নিরলস চেষ্টা চালানো সব নাগরিকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নতি ও স্বনির্ভর হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে। সব মেধাবী মানুষ যদি নিষ্ঠা ও সদিচ্ছার সঙ্গে শিক্ষা, নৈতিকতা, বিজ্ঞান, উৎপাদন, বিনিয়োগ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সুশাসন, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, রপ্তানি বৃদ্ধিসহ সব সেক্টরে দেশ ও জাতির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে তাহলে ইনশা আল্লাহ আমাদের দেশ আরও এগিয়ে যাবে। আসুন, আমরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে দেশ ও জাতির কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও সুনামের জন্য একযোগে কাজ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন।
স্বাধীনতার ৪৬ পর এসে কিছুটা ভারমুক্ত হয়েছে জাতি৷ যারা একসময় মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন, যারা অনেক বছর বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রেবিন্দুতে ছিলেন, সেইসব যুদ্ধাপরাধীদের কারুর বিচার হয়েছে, কারও কারও বিচার চলছে৷ এ পর্যন্ত ছ’জন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে৷ এরা হলেন কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী এবং মীর কাসেম আলী৷ কারাভোগ করার সময় মৃত্যু হয়েছে দু’জনের৷ ট্রাইব্যুনালে ২২ জনের রায় হয়েছে, এদের মধ্যে চারজন পলাতক৷ চূড়ান্ত রায় হয়েছে ১১ জনের৷ ১৩ জনের বিচার এখনও প্রক্রিয়াধীন৷
২০০৮ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ৷ তাদের অন্যতম নিরবাচনি অঙ্গীকার ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার৷ শেখ হাসিনার নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়৷ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়৷
১২ই ডিসেম্বর ২০১৩৷ এ দিন রাতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ মানবতাবিরোধী অপরাধে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডই বাংলাদেশে প্রথম কার্যকর হওয়া যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি৷
সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডের দায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মত অনুযায়ী, কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে আপিল বিভাগ৷ ২০১৫ সালের ১১ই এপ্রিল কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদে — এই দু’জনকে ২২শে নভেম্বর ২০১৫ শনিবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে পাশাপাশি দু’টি মঞ্চে ফাঁসি কার্যকর করা হয়৷
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের আমির ও একাত্তরের বদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১৬ সালে ১১ই মে রাত ১২টা ১ মিনিটে৷
২০১৬ সালে ৩রা সেপ্টেম্বর রাতে কার্যকর হয় চট্টগ্রামের কসাই মীর কাসেম আলীর ফাঁসি৷ জামায়াতের প্রধান অর্থ যোগানদাতা মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছিল৷